যে কোন পরিবারেই নতুন সন্তানের আগমনের খবর বিশাল এক আনন্দের সংবাদ। বিভিন্ন দেশে নতুন সন্তান আগমন উপলক্ষে যেমন বিভিন্ন রীতি-নীতি পালিত হয়, আবার এসব রীতি-নীতির হাত ধরেই আসে ভয়াবহ সব কুসংস্কার। আজকের লেখা সেরকমই কিছু কুসংস্কার নিয়ে।
বাংলাদেশে এটা খুব জনপ্রিয় ধারণা যে, গর্ভবতী মায়ের পেটের আকৃতির উপর অনাগত সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে-সেটি নির্ভর করে। যদি পেট সামনের দিকে কিছুটা ঝুলে থাকে তবে সন্তান হবে ছেলে। আর যদি গর্ভাবস্থায় মায়ের পেট অনেক বড় হয়, তবে গর্ভের সন্তান হবে মেয়ে। যদিও এই কথার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এগুলো প্রাচীন লোককথার মতোই মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই ধরণের কুসংস্কারের উপর ভিত্তি করেই গর্ভবতী মায়ের সাথে আচরণ করা হয়। পেটের আকৃতি থেকে ছেলে সন্তান আসার সম্ভাবনা বোঝা গেলে গর্ভবতী মায়ের আদর-যত্ন বেড়ে যায়। আর উল্টোটা হলে, অর্থাৎ মেয়ে সন্তান জন্মের লক্ষণ দেখা দিলে অনেক পরিবারেই গর্ভবতী মায়ের ভাগ্যে জোটে অবহেলা। অথচ, গর্ভের সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে- সেটা নির্ভর করে ক্রোমোসম, মায়ের শরীরের গঠন ও মাতৃগর্ভে ভ্রূণের অবস্থানের উপর।
আবার গর্ভস্থ শিশুর বয়স সাত মাস হলে, গর্ভবতী মাকে দেখতে আসা অতিথিরা মায়ের শাড়ির আঁচলে বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য রেখে দেন। বিশ্বাস করা হয়, এর মাধ্যমে গর্ভবতী মা ও তার গর্ভস্থ সন্তানের শরীর সুস্থ থাকবে। কেউ কি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে, কিভাবে মায়ের আঁচলে রাখা খাবার থেকে খাবারের পুষ্টিগুণ মা ও তার গর্ভের সন্তানের শরীরে যাবে? এটা হলে তো আর শরীরের ভেতরে স্রষ্টা খাবার পরিপাকের জন্য এত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন পাকস্থলী বানাতেন না। তো আর শরীরের ভেতরে স্রষ্টা খাবার পরিপাকের জন্য এত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন পাকস্থলী বানাতেন না।
এখানেই শেষ নয়। গর্ভবতী মায়েদের সূর্য-গ্রহণের দিন ঘরের ভেতর থাকতে বলা হয় আর শাক-সবজি কাটাকুটির কাজ করতে নিষেধ করা হয়। বলা হয়, এরকম না করলে গর্ভের সন্তানের মাঝে নানা জটিলতা দেখা দিবে।
আবার আরেকটি ধারণা প্রচলিত আছে, কোন গর্ভবতী মা গর্ভাবস্থায় সেলাইয়ের কাজ করলে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিবে। যদিও এই প্রশ্নটি থেকেই যায়, মানুষের জন্ম গ্রহণের সাথে সূর্যের কিংবা সেলাইয়ের কাজের কি সম্পর্ক আছে?
অনেক স্থানে বিশ্বাস করা হয়, মধ্য দুপুর বা সন্ধ্যায় কোন মা ঘরের বাইরে বের হলে তার গর্ভের সন্তানকে ভূত বা খারাপ বাতাস ক্ষতি করবে।
এতো গেল, সন্তান জন্ম হবার আগের কিছু কুসংস্কার। সন্তান জন্ম হবার পরপরই শুরু হয়ে রীতি-নীতির নামে নানা রকম কুসংস্কার।
সন্তান জন্মের পর একটা সময় ছিল, মায়ের শাল-দুধ সদ্য-ভূমিষ্ঠ সন্তানকে খেতে দেয়া হতো না। অথচ বিজ্ঞান বলছে, এই শাল-দুধই শিশুর জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয়।
এসব কুসংস্কার যে স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষের মাঝেই রয়েছে তা কিন্তু নয়। অনেক শিক্ষিত মানুষ, যারা নিজেদেরকে বিজ্ঞান-মনস্ক বলে দাবি করেন, তাদের মাঝেও দেখা যায়। আর এই কুসংস্কারের ফলে অনেক গর্ভবতী মা অপুষ্টির শিকার হন, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান কিংবা ছেলে বা মেয়ে সন্তান জন্মদানের উপর ভিত্তি করে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন। তাই যদি আমরা নিজেদের বিজ্ঞান-মনস্ক বলে দাবি করি, তবে এখনি সময় এসব ভ্রান্ত কুসংস্কারের মূল উৎপাটন করা। আমাদের একটু সচেতনতাই আমাদের দিতে পারে সুস্থ মা ও সুস্থ সন্তান।