অনেক বছর থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের মাঝে কফি পানের প্রবণতা বিদ্যমান এবং দিনে দিনে কফি পানকারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাংলাদেশেও আজকাল বহু মানুষ বাড়ীতে কর্মক্ষেত্রে বা শুধুমাত্র বিনোদনের সময়ও কফি পান করছেন। সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের দিনের আরম্ভ হয় এক কাপ উষ্ণ কফির সঙ্গে। কিন্তু আপনি কি জানেন তার মনোমুগ্ধকর সুবাস,স্বাদ এবং স্বতন্ত্র গন্ধ ছাড়াও কফি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। কফি গাছের বিচি, কফি বীনকে গুঁড়া করে ব্যবহার যোগ্য কফি তৈরী করা হয়। তবে এই গুঁড়ার বহু রকম হতে পারে। যেমন- মিহি, দানাদার ইত্যাদি। এই গুলো দিয়ে তৈরী কফিও বিভিন্ন রকম হতে পারে- গরম, ঠাণ্ডা, বরফীকৃত ইত্যাদি। কফি প্রধানত উষ্ণতা প্রদান করে বা মনকে চাঙ্গা করে। এটি মানসিক ও শারীরিকভাবে শক্তিকারকও হতে পারে। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আরো কিছু চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গিয়েছে যা নিম্নে বর্ণিত হলো-
হার্ট এ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়ঃ
কফি পান হার্টএ্যাটাক ও হার্ট এ্যাটাকের কারণে মৃত্যুর হার কমাতে পারে এমন তথ্য পাওয়া গিয়েছে অনেক গবেষণায়। ১৫ বছর ব্যাপী ৪১,০০০ (একচলিশ হাজার) মহিলার অংশগ্রহণে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে প্রত্যহ ৩ কাপ করে কফি পান হার্ট এ্যাটাকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সক্ষম। পুরুষদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ তথ্য পাওয়া গিয়েছে। কফিতে ক্যাভনয়েড নামক শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট আছে যা হৃদ রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে।
রক্তনালীর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে :
চা বা চকলেটের চেয়ে কফিতে অধিক পরিমাণে ক্যাফেইন থাকে। এ ক্যাফেইন রক্তের এলডিএল (ক্ষতিকারক কলেস্টেরল) কমাতে এবং এইচডিএল (উপকারী কলেস্টেরল) বৃদ্ধি করতে ভূমিকা রাখে। এ দুটির অস্বাভাবিক উপস্থিতি রক্তনালীকে সরু করে যা এর দূরবর্তী অংশে রক্ত সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করবে। এর ফল স্বরূপ হার্ট এ্যাটাক, স্ট্রোক বা পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজিজ হতে পারে। যারা এ সবের ঝুঁকিতে আছেন তাদের জন্য প্রত্যহ ৪ কাপ কালো কফি পান খুবই উপকারী হবে।
বদহজমের সমাধানঃ
কফি নিয়মিত ভাবে খাদ্যের বিপাকীয় ক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে এবং যাদের হজমজনিত সমস্যা আছে তাদের জন্য কফি উপকারী। বিশেষ করে যাদের দিনে কয়েকবার মল ত্যাগ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাদের ক্ষেত্রে কফি পান অতি দ্রুত দৃশ্যমান উন্নতি ঘটাতে পারে।
ক্যান্সার প্রতিরোধকঃ
বর্তমান বিশ্বে ক্যান্সার আতঙ্কজনক হারে বিরাজ করছে। অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করছে এবং অনেকগুলো ক্যান্সারের তেমন কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা আমাদের জানা নেই। এর মধ্যেও কিছুটা আলো ছড়াতে পারে নিয়মিত কফি পান। গবেষণায় দেখা গেছে কফি পায়ীদের মধ্যে কোলন ক্যান্সার হবার ঝুঁকি যারা কফি পান করে না তাদের তুলনায় চার ভাগের এক ভাগ। নিয়মিত কফি পান ফুসফুস, প্রোস্টেট, স্টোন, জরায়ু, যকৃৎ, পাকস্থলি এবং অগ্ন্যাশয় ক্যান্সার হবার ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।
দাঁতের ক্ষয় রোধঃ
সুন্দর দাঁতের সুন্দর হাসি সবার ভালো লাগে, কিন্তু দাঁত ক্ষয়ে যাওয়ায় এখানে বাঁধা স্বরূপ। নিয়মিত কফি পান (রোস্টেট কফি) এই ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
মাথা ব্যথা সারাতেঃ
আমার মনে হয় এই তথ্যটি অনেকেরই জানা যে, মাথা ব্যথা করলে কফি পানে তা সেরে যায়। যে কোনো ধরনের মাথা ব্যথা হলে কফি পান করলে উপকার পাওয়া যেতে পারে। মাথা ব্যথার সময় রক্তনালী প্রসারিত হয়, কফির ক্যাফেইন সংকুচিত হতে সহায়তা করে। যার ফলশ্রুতিতে মাথা ব্যথা কমে।
সামগ্রিক মৃত্যু ঝুঁকি হ্রাসঃ
পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিয়মিত কফি পানে সামগ্রিক মৃত্যু ঝুঁকি কমপক্ষে ৫ শতাংশ কমতে পারে। ৪ লক্ষ বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপর ১৪ বছর ব্যাপী পরিচালিত গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, কফি পায়ীদের মৃত্যু ঝুঁকি কম। যারা দিনে ২-৩ কাপ কফি পান করেন তাদের ১০ শতাংশ এবং যারা ৪-৫ কাপ কফি পান করেন তাদের ১৪ শতাংশ মৃত্যু ঝুঁকি কমে। মহিলারা কফি পানে আরো বেশি উপকৃত হবে তবে গর্ভাবস্থায় বাদে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়ঃ
নিয়মিত কফি পান ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। সম্প্রতি এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এর প্রমাণ পেয়েছেন। তারা দেখেছেন, কফির তিনটি যৌগের সমন্বয়ে গঠিত প্রোটিন শরীরে ডায়াবেটিস হওয়ার জন্য দায়ী রক্তের ক্ষতিকর উপাদান প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এ ক্ষতিকর উপাদানই মূলত শরীরে দীর্ঘমেয়াদি ডায়াবেটিস রোগের সূত্রপাত ঘটায়। শরীর যখন প্রয়োজনীয় ইনসুলিন উৎপাদনে কাজ করতে পারে না, কফির নির্যাস রক্তে ইনসুলিন উৎপাদক কোষ ধ্বংসকারী ক্ষতিকর টক্সিক উপাদান দমন করে মানুষকে ডায়াবেটিসের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়। গবেষকরা প্রমাণ পেয়েছেন কফির উপাদান ক্যাফেইন, ক্যাফেইক এসিড ও ক্লোরোজেনিক এসিড ডায়াবেটিক চিকিৎসায় আরও কার্যকর সহায়তা করতে পারে।
অ্যান্টি অক্সিডেন্ট:
২০০৫ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে যে, কফির মতো অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আর কোন খাবারই ভুবনে তৈরী হয়নি। যদিও ফলমূল এবং শাকসবজিতে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান রয়েছে কিন্তু তার কোনোটিই কফির ধারকাছে নেই।
পার্কিনসন রোগ নির্মূলে:
বিজ্ঞানবিষয়ক দৈনিক সায়েন্স ডেইলি জানায়, পার্কিনসন রোগাকান্ত ব্যক্তিরা কফি পানে দারুণভাবে উপকৃত হতে পারেন। কফি তাদের এই রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে। শুধু রোগাক্রান্তরাই নয়, নিয়মিত কফি পান করলে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা যারা কফি পান করেন না তাদের তুলনায় কম।
লিভারের জন্য উপকারী:
কফি মানবদেহের লিভারের জন্য অত্যন্ত উপকারী। বিশেষভাবে কেউ যদি অ্যালকোহল আসক্ত হয়ে থাকে তাহলে তো কোন কথাই নেই। ২০০৬ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন কফি পান করেন তাদের লিভার সিরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা ২০ ভাগ কম। যারা অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ করে থাকেন তাদের লিভার সিরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আত্মহত্যার ঝুঁকি কমাতে:
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ২-৪ কাপ কফি পান করলে ছেলেদের আত্মহত্যার ঝুঁকি হ্রাস পায় আর মেয়েদের আত্মহত্যার ঝুঁকি অর্ধেকে নেমে আসে।
ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাসকরণে ভূমিকাঃ
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মেয়েরা দৈনিক তিন বা ততোধিক কাপ কফি পান করেন তাদের ত্বকের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি যারা করে না তাদের চেয়ে অনেক কম।
দীর্ঘদিন মস্তিষ্ক সুস্থ্য রাখতে:
কফিতে বিদ্যমান ক্যাফেইন স্মৃতিভ্রষ্টতা প্রতিরোধ করে। ৬৫ বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তিদের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন ৩ কাপ কফি খাওয়ার কারণে তাদের মনে রাখার ক্ষমতা বেড়েছে।
বুদ্ধিমান করে তোলে:
সিএনএন এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কফি আপনাকে শুধু চাঙ্গা করবে তাই নয়, আপনার বুদ্ধিকেও কিছুটা শাণিত করতে পারে। কফির উপাদান ক্যাফেইন স্নায়বিক কর্মকাণ্ডকে ত্বরান্বিত করতে পারে। নিয়মিত কফি পানে মানসিক অবস্থার উন্নতি হতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে গঠনমূলক মনোভাব তৈরীতে সহায়ক হতে পারে।