নিউটন ও আইনস্টাইন যা বলেছিলেন

নিউটন ও আইনস্টাইন যা বলেছিলেন
নিউটন ও আইনস্টাইন যা বলেছিলেন

একটি মানুষের কি একই সঙ্গে দু’জায়গায় থাকা সম্ভব? বিজ্ঞানমনস্ক যে কেউ এই কথাকে সরাসরি বাতিল করে দেবেন। এর ব্যতিক্রম ছিলেন না আইনস্টাইন নিজেও। নিউটন ও আইনস্টাইনের চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানে এমন কোনো বিষয়ের স্থান নেই। কিন্তু এমন অদ্ভুত নিয়মের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রকৃতির এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটার পক্ষে প্রমাণ মিলছে বার বার। সম্প্রতি টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী, প্রফেসর হোয়ার্ড ওয়াইজম্যান ও তাঁর সহকর্মীরা মিলে একটি পরীক্ষণে এমন ঘটনা ঘটার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তাদের এই গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

বস্তুজগতে আমরা যেসব বৈজ্ঞানিক নিয়ম কার্যকর দেখি, অনু-পরমাণু ও তাদের অতি-পারমাণবিক কণিকার ক্ষেত্রে এ নিয়ম একদমই কার্যকর নয়। এসব ক্ষুদ্র কণিকা মেনে চলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভুত সব নিয়ম। তেমনই একটি নিয়ম হলো এরা একই সময়ে দুটি বা তারও বেশি অবস্থানে থাকতে পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভাষায় বললে বলা যায়, এরা একই সঙ্গে সম্ভাব্য সব পথে চলাচল করে। অদ্ভুত নিয়মের কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ‘কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গলমেন্ট’ নামে আরও একটি আশ্চর্য নিয়ম রয়েছে।

বাংলায় একে যুগ্মসম্পদ বলা যেতে পারে। দুটি কণিকা যদি এই নিয়মে সম্পর্কিত হয়, তাদের বলা হয় এন্টেঙ্গলড পেয়ার। এই নিয়মে যেসব কণিকা সম্পর্কিত, তাদের পর্যবেক্ষণ করার আগ পর্যন্ত, কোন কণা ঠিক কোন অবস্থায় আছে তা আমরা জানতে পারব না। তবে পর্যবেক্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গেই কণাটির সব বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়ে যাবে। কয়েক আলোকবর্ষ দূরে হলেও এদের যেকোনো একটিকে পর্যবেক্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা জেনে যাব আলোকবর্ষ দূরের কণাটি এখন কোন অবস্থায় আছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়_ ধরুন কোনো শক্তিশালী পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে একই সেলে থাকা দুটি ইলেক্ট্রন বিপরীত দিকে প্রায় আলোর বেগে ছুটে চলেছে। এরা যেহেতু একটি এন্টেঙ্গেলড পেয়ার, ফলে এদের একটির স্ক্রিন (ঘূর্ণন) ওপরের দিকে হলে অন্যটির অবশ্যই নিচের দিকে হবে। এখন কয়েক বছর অপেক্ষা করুন। ইলেকট্রন দুটি এই মুহূর্তে পরস্পরের থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। এবার যখনই আমরা কোনো একটির স্ক্রিন মেপে দেখব যে এটি ওপরের দিকে, সেই মুহূর্তেই অন্য ইলেকট্রনটি জেনে যাবে যে তার স্ক্রিন এখন থেকে নিচের দিকে। ফলে দেখা যাচ্ছে আলোর গতির থেকেও বেশি গতিতে তথ্য পরিবাহিত হচ্ছে। আর এ কারণেই আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিরোধী ছিলেন। এমনকি তিনি আর তার দুই সহকর্মী (পডলস্কি ও রোজেন) মিলে একটি আর্টিকেলে (ইপিআর আর্টিকেল) এই বিষয়টি দেখিয়েছিলেন যে, এভাবে আলোর গতির থেকে বেশি গতিতে তথ্য পরিবাহিত হয় যা আপেক্ষিক তত্ত্বের লঙ্ঘন। তাই কোয়ান্টাম মেকানিক্স সত্য হতে পারে না।

কিন্তু বাস্তবিক পরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গেল, আইনস্টাইন ও তার অনুসারীরা ভুল ছিলেন। আশির দশকের প্রথমদিকে এলান অ্যাস্ট্রেক্ট ও তার সহকর্মীরা মিলে ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট করতে সফল হন। এই পরীক্ষায় দুটি ডিটেক্টর ১৩ মিটার দূরে ছিল। এখানে একটি ক্যালসিয়াম পরমাণু থেকে নিঃসরণ হওয়া ফোটনকে মেপে দেখা হয়। এরপর ১৯৯৭ সালে আরও একটি ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট পরিচালনা করা হয়। এই পরীক্ষার ডিটেক্টরগুলো ১১ কিলোমিটার দূরে ছিল। দুটি পরীক্ষায়ই কোয়ান্টাম মেকানিক্স জয়ী হয়। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন বিশেষ ধরনের তথ্য আলোর চেয়ে বেশি গতিতে পরিবহন হওয়া সম্ভব। ওপরের কথাগুলোর অর্থ কিন্তু এই না যে, আমরা আলোর গতির থেকে বেশি গতিতে কোন বার্তা পাঠাতে পারব। এভাবে শুধু কোয়ান্টাম জগতের এলোমেলো তথ্য পরিবাহিত হতে পারে। আর তাও, যখন আমরা কোনো কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য পরিমাপ করে দেখব, তখনই এটি নির্ধারিত হবে। কিন্তু আমরা নিজেরা কোন কিছু নির্ধারণ করতে পারব না।আগে যেসব ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছিল সেগুলো হয়েছিল দুটি কণিকার কোয়ান্টাম অবস্থা নির্ধারণ নিয়ে। কিন্তু এবারের পরীক্ষাটি একটু অন্যরকম।

এবারের পরীক্ষাটি করা হয়, ‘একটি’ কোয়ান্টাম কণিকার ওপর। আর এবারের পরীক্ষাটি কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গলমেন্ট ছাড়াও এটিও নিশ্চিত করেছে যে, একটি কণিকা একই সময়ে একের অধিক স্থানেও থাকতে পারে। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে, কণিকা এই যে একই সময়ে দুটি অবস্থানে থাকতে পারে, তা আসলে কীভাবে সম্ভব? বিজ্ঞানীরা বলেন, একটি কণিকাকে একটি তরঙ্গ ফাংশনের সাহায্যেও বর্ণনা করা যায়। আর এই তরঙ্গ-ফাংশন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ না থেকে সেই স্থান থেকে আলোকবর্ষ দূরেও বিস্তৃত থাকতে পারে। এই তরঙ্গ ফাংশন যতদূর ছড়িয়ে পরবে_ কণিকাটিকে একটি সময়ে সেই সব অবস্থানেই পাওয়া সম্ভব। এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞানীরা এবারের পরীক্ষাটি করেন। তারা বিশেষ স্পিল্গটারের সাহায্যে একটি ফোটনের (আলোর কণিকা) তরঙ্গকে কেটে দুটি আলাদা গবেষণাগারে পাঠান।

তারপর হোমোডাইন ডিটেক্টররের সাহায্যে দুটি আলাদা গবেষণাগার থেকে এগুলোকে পরিমাপ করেন। পরীক্ষায় দেখা গেল যদি প্রথম গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা ফোটনটিকে পর্যবেক্ষণ করে ফেলেন, তবে দ্বিতীয় গবেষণাগারের ডিটেক্টর কোন কিছুই শনাক্ত করতে পারে না। আবার যদি দ্বিতীয় গবেষণাগারের ডিটেক্টর ফোটনটিকে শনাক্ত করে, তবে প্রথম গবেষণাগারের ডিটেক্টক কোনো কিছুকে শনাক্ত করতে পারে না। এর থেকে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, ফোটনটির ওয়েব ফাংশন দুই ভাগ হয়ে একই সময়ে দুটি গবেষণাগারেই যায়, কিন্তু পর্যবেক্ষণ করার পর তারা একটি নির্দিষ্ট অবস্থানেই থাকে।

Leave a Reply